কে তুমি?
১ম পর্ব (অদ্ভুত অনুভূতি)
আজ অজানা এক শক্তির ডাকে খুব ভোরেই ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম থেকে উঠেই আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখে খুব বিস্মিত হই। বাহ! নিজের চুল-দাড়ির প্রশংসা নিজেই করতে হয়। কারণ এত বড় হয়েছে যে, নিজেকে আর মানুষের মত মনে হচ্ছে না। কল্পনায় নিজেকে একটা এলিয়েন ভেবে নিলাম। জীবনে, নিজেকে বহুবার এলিয়েন কল্পনা করে, খুব মজা নিয়েছি। তার সাক্ষী কেবল আয়নায় ছিল কিন্তু ভুল ক্রমে আজ মা ও হয়ে গেল। তারপর মা কয়েকখানি মুচকি হাসি দিয়ে হাতে ব্রাশটা ধরিয়ে দিল। আর বলল, “খোকা, এমন গভীর দৃষ্টি আর পলক হীন ভাবে কাকে দেখছিলে?” মা অবশ্য মাঝে মাঝে নানা বিষয়ে একটু একটু মজা করে থাকে।
সকালের নাস্তা নিয়ে বসেছি, ভেতরে ভেতরে যেন কেমন একটা অনুভূতি কাজ করতেছে। প্রতিটা সকালের নাস্তায় মাকে নানা ভাবে হয়রানি করা হয়। এটা লাগবে, ঐটা লাগবে, এটা খাব না, এমন ভাবে খাব না এমন নানা বাহানায় মাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। আজ অন্তরের এক অদ্ভুত অনুভূতি পুরো সিস্টেমটা কে পাল্টে দিয়েছে। এই অনুভূতিটা অনুভূতিই তা লিখে বর্ণনা করা যাবে না। ( সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইলো ) ভেতরে ভেতরে একটা অস্থির তাড়না কাজ করতেছে। নাস্তা করতে বসে ঘন্টার উপর সময় পার করে দিয়েছি, একটা অজানা শক্তি মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে আর একটু একটু করে নাস্তা মুখে যাচ্ছে। মা বোধহয় ভোর থেকেই আমাকে খেয়াল করতেছে, তাই মায়ের এমন প্রশ্নের জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। মা হঠাৎ করে বলে উঠল, ”খোকা, দোকানে যাবি নাকি? ভাল লাগবে।” কিছু সময় এটা নিয়েই ভাবনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ করে কিছু না বুঝতে পেরেই বলে উঠলাম, ”যাব।” তারপর মা একশত টাকার একখানি নোট হাতে দিয়ে জীবনের দোকানে যাবার আদেশ দিল। কিছু সময় পূর্ব পর্যন্ত বুঝতে ছিলাম না, কোন দোকানে? কেন যাব? এখন বুঝতে পেরেছি।
বাই-সাইকেল টা নিয়ে পনেরো-ষোলো মিনিটের মধ্যে জীবনের দোকানে পৌঁছে গেলাম। গিয়ে দেখি ঠিক আমার মত একজন তবে আমার চেয়ে তার শরীরের রং ছিল হালকা কালো। বয়স আর উচ্চতা আমার কাছাকাছি হবে। যাওয়া মাত্রই সে আমার মনের প্রশ্নটা করে ফেলল, “এই ছেলে, তোমার সাথে কি আমার কখনও দেখা হয়েছিল? হুবহুও আমার মত চুল-দাঁড়ি রাখছো কেমন করে!” আমি প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই আরেকটি প্রশ্ন করে বসলাম, “ তুমি কি আমাকে চেন?” সে মাথা নেড়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ”। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত একটা অনুভূতি অনুভব করি। মনে আরও নানা প্রশ্ন ভনভন করতেছে, ঠিক এমন সময়ই জীবনের ডাক পরে যে আমাদের দু’জনেরই চুল ছাটার সিরিয়ালে পৌছে গেছি। চুল কাটার পর আমার সাথে কথা আছে, সিটে বসার পূর্বে সে আমাকে পরিষ্কার করে জানিয়ে দিল। এতে আমি ও অবুঝের মত হ্যাঁ করে দিলাম।
প্রায়ই ঘন্টা খানেকের মধ্যে সেলুনের কাজ সমাপ্তি ঘটলে, দু’জন একসাথে দোকান থেকে কিছুটা দূরে নির্জনে বড় বট বৃক্ষের নিচে গিয়ে বসি। প্রথমে আমরা কিছুক্ষণ নীরবে ধীরগতি প্রাণীর মত চুপচাপ বসে থাকলাম। এমনতেই আমি অচেনা মানুষের সাথে তেমন মিশতে পারি না ফলে নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে কথা বলা কল্পনায় মাত্র। বললাম না, অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করতেছিলো, সেটা সেখানে বর্তমান ছিলো। ফলে, আমি আবেগময় হয়ে তার নাম ও ঠিকানা জিঙ্গেস করি। উত্তরে কেবলে তার “দিব্য” নাম টুকুই বলে, ঠিকানা দিতে রাজি হয় নি। পক্ষান্তরে সে আমার পরিচয় নিয়ে কোন প্রশ্নই করে নি বরং আমি বলতে যাওয়ায় আমাকে থামিয়ে দিয়ে সে নিজে থেকেই আমার পরিচয় দিতে লাগল। সে বলল, “তুমি শীতল। বিজ্ঞানের ছাত্র আর বিজ্ঞান সম্পন্ন গল্প গুলো তোমার প্রিয়। অজানাকে জানার জন্য প্রবল ইচ্ছা শক্তি রয়েছে। নানা সময় নানান জিনিস নিয়ে ভাবতে তোমার খুব ভাল লাগে। তোমার ভাবনা গুলো আমাকেও ভাবায়। যেমনটা তুমি আজ অনুভব করিতেছ তেমনটা আমারও হয়।” এভাবে আমার জানা-অজানা, দুর্বল-সবল দিক গুলো নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে বলেই চলছিলো। আমি ভালো শ্রোতা হয়ে মনোযোগ দিয়ে সকল কথা শুনিতেছিলাম। আমি একজন ভালো শ্রোতা এবং সহজেই কারো বন্ধু হয়ে যেতে পারি, সে এই গুনগুলোর প্রশংসা করেছে। এক প্রহরেরও কম সময়ে আমাদের মধ্যে খুব ভালো মৈত্রী তৈরি হল। আমি আমার মনের সকল কথা, পরিকল্পনা, লক্ষ্য এবং ইচ্ছা গুলো কি তা তাকে জানিয়ে দেই। আমাদের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে কথোপকথন চলে। কথোপকথনের সময় মনোযোগ দিয়ে তার বিভিন্ন জিনিস খেয়াল করে দেখছিলাম। কথার শুরুতে সে তার মানিব্যাগ থেকে ন্যানো আকারের একটা ডিভাইস তার কানে লাগিয়ে দিল। সে যে চশমা টা পড়েছিল তা আমার চশমা থেকে কয়েক সহস্র গুণ উন্নত। তার চশমাটা থেকে যে আলো নির্গত হচ্ছে তা আমাকে আর ও বিস্মিত করে। তার হাতে ঘড়ির দিকে নজর পড়লে আমি বাক রুদ্ধ হয়ে যাই। যেখানে আমার ঘড়িতে ১১ টা ২৮ মিনিট(সকাল) সেখানে তার ঘড়িতে ৫ টা ৫৬ মিনিট(সন্ধ্যা)। সে তার ঘড়ির দিকে বার বার তাকাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তার খুব তাড়া আছে। আমি তার চশমটা পড়ার জন্য চাইলে সে বলে,
- ভাইয়া, এটা পড়ার সময় তোমার এখনও হয়নি।
-কেন?
-সময় আসলে সবই উপলব্ধি করতে পারবে। তুমি যে সকল উপাদান দিয়ে তৈরি, আমিও সেসকল উপাদান দিয়ে তৈরি। তোমার-আমার জিনের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে।
-ওহুহ। আচ্ছা, তুমি আমাকে এত ভালো করে জান তারপরও ঠিকানা বলতেছো না কেন? আমার আশেপাশের কোন গ্রামে তোমাকে কখনও দেখি নাই!
- হুম, ঠিকানা অনেক দূরের। বললেও চিনবে না, তাই বলি নাই। ঠিকানা নিয়ে কোন প্রশ্ন করবে না প্লিজ। আমি তোমার সাথে দেখা করে কিছু বলা জন্য এখানে এসেছি।
-( কিছু সময় আশ্চর্য হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে ) কি? তুমি আমাকে কিছু বললে সেটা নিশ্চয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে!
- হ্যাঁ, তোমাকে এখন থেকেই তোমার স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। অন্য দশ জনের মত যে বাজে স্বভাব গুলো তোমার মাঝে প্রতিমান সে গুলো বর্জন করতে হবে।
- তুমি কি আমার ভবিষ্যৎ দেখতে পাও?
- একজন মানুষের পক্ষে কারো ভবিষ্যৎ দেখা অসম্ভব, তবে কল্পনা করা যায় কিংবা বৈজ্ঞানিক ভাবে হিসাব করে বলে যায় কি ঘটবে।
- তা ঠিক। তুমি এত যুক্তিসংগত কথা বল যা আমাকে মাঝে মাঝে আরও বেশি বিস্মিত করে তোলে।
- কথা গুলো আরও মনোযোগ দিয়ে শোন। আমাদের চারপাশে যত ধরনের জীব আছে তাদের সবারই মিউটেশন ঘটে। কেননা পিতা-মাতার বৈশিষ্ট্য ভিন্ন, ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ক্রসে কিছু মিল সম্পন্ন আরেকটি ভিন্ন জীবের উৎপত্তি হয়। তাছাড়া যেসকল এক কোষী প্রাণী বিভাজনের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করে তারা খুব সহজেই ডিএনএ বা আরএনএ এর পরিবর্তন ঘটিয়ে নিজেদের প্রজাতি সংখ্যা বৃদ্ধি করে থাকে।
- আচ্ছা, আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি?
- বল?
- আমরা সবাই জানি, বর্তমানে প্রযুক্তির আশীর্বাদে সবার ঘরে ঘরেই বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিকস ডিভাইস আছে যা এখন পর্যন্ত বিনোদনের মাধ্যম হিসাবেই ব্যবহার হচ্ছে। এগুলো কিভাবে মানব জীবনে অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠতে পারে?
- হ্যাঁ, ইলেকট্রিকাল যন্ত্রপাতি গুলোই হবে মানব জীবনের চালিকা শক্তি। খেয়াল করে দেখ, এর ফলাফল তোমার বর্তমানেই আছে।
- হুম, বর্তমানে মোবাইল আর কম্পিউটার ব্যবহারিক জীবনের অপরিহার্য। এগুলো আমাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে। আচ্ছা, তুমি কোন বিষয়ে পড়তেছো? দেখতে, তুমি আমার সমবয়সী তথাপি তোমাকে একজন জ্ঞানী অভিজ্ঞ শিক্ষক এর মত মনে হচ্ছে!
- তুমি ঠিকই ধরতে পেরেছো! আমার পড়াশোনা শেষ, যারা তোমার মত জ্ঞানের পিপাসু তাদের কিছু শিখাতে দূরদূরান্তে ঘুরে বেড়াই। আর হে, বয়সে তুমি আমার থেকে অনেকটাই ছোট হবে। আমি স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রেখেছি, তাই তোমাকেও বলেছি স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখ।
- তুমি করে বলে কি অসম্মান করে ফেলেছি?
- আরে নাহ্! আমরা দু'জনেই খুব ভালো বন্ধু। বন্ধুকে তুমি বলাই শ্রেষ্ঠ, আপনি নয়।
সম্পর্ক নিয়ে সে নানা কিছু বোঝায়, চারপাশের পরিবেশ নিয়েও অনেক কিছু বলে। এভাবে চলতে থাকলে পরিবেশের বিরাট একটা পরিবর্তন আসবে ফলে মানুষে মানুষের সম্পর্কের ও পরিবর্তন ঘটবে। দিন দিন মানবের বংশগত বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হচ্ছে, যা মানব সমাজকে অন্য ভিন্ন একটা পথে নিয়ে যেতে পারে বলে সে মনে করে। সে আরও মনে করে মানুষ তাদের বৈশিষ্ট্য যথাযথ উন্নয়ন বা রক্ষার জন্য কৃত্রিম উপায় গ্রহণ করতে পারে। সে আমার সাথে কথা বলছিল আর বার বার তার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল। ফলে আমি নীরব না থেকে সাহস করে বলে ফেললাম,
- তোমার ঘড়ির সময়টা ভুল। এখন দুপুর ১২ টার উপরে। পক্ষান্তরে তোমার ঘড়িতে সন্ধ্যা হয়েছে ইঙ্গিত করে।
- এটা আমার হিসাবের সময়। পরবর্তীতে এই ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। আমি কিছু সময়ের ভেতরেই চলে যাব…
- এই ঘড়ির ডিজাইনটা এমন কেন? তুমি এই ইলেকট্রিক ডিভাইস গুলো কোথায় পেলে যা আগে কখনও দেখি নাই!
- তোমরা যে কম্পিউটার ব্যবহার করে বিনোদনে নিমিত্ত সে কম্পিউটারই হবে বেচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। বর্তমান থেকে এ আপগ্রেড হবে, রূপের বিকৃতি ঘটবে, কাজ করার সিস্টেম পাল্টাবে। বিভিন্ন গবেষণায়, জটিল জটিল কাজ কিংবা প্রশিক্ষণে এর বহুমাত্রিক ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে, ভবিষ্যৎ দিন গুলোতে এটি হতে পারে বেচে থাকা যুদ্ধের একমাত্র হাতিয়ার। উন্নত অঞ্চল গুলোতে এই বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে তাদের জীবনকে আরও সহজ করা শুরু করে দিয়েছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি, ব্যবসা সহ নানা কাজে তা যেমন ব্যবহৃত হচ্ছে তেমনি তার সাথে সাথে মানবকে আরও দক্ষ হয়ে উঠতে হবে তা না হলে অনেক পিছিয়ে যেতে হবে। আমার ব্যবহৃত জিনিস গুলো নিয়ে আবার দেখা হলে বিস্তারিত বলব। সময় হয়ে গেছে, চলে যেতে হবে। অনেক কিছু বলা বাকি রয়ে গেছে….
- কে তুমি?
সে আর কোন কথা না বলে, আমার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে দু’জনের একটা সেলফি তুলল। আমার সাথে আলিঙ্গন করা মাত্রই ভেতরে ভেতরে একটা প্রশান্তি অনুভব হল। সকল অস্থিরতা দূরে চলে গেল। সে তার বাইক নিয়ে মেইন রোডের দিকে চলে গেল, আর আমি আমার বাই-সাইকেল নিয়ে বাড়ির দিকে। তবে অনেক প্রশ্ন প্রশ্নই হয়ে থাকল মন চাচ্ছিল তার সাথে দূরদূরান্তে ঘুরতে, আর অজানা নানা কৌতূহল এর সমাপ্তি ঘটিয়ে নতুন কিছু করতে।
Click Here , To Read 2nd Part - “স্বপ্নের রানী”
[ ২য় পর্ব, খুব দ্রুত আসবে। ২য় পর্ব হবে “স্বপ্নের রানী”। ]
লিখটাটি কপি করে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া, আইনগত দণ্ডনীয় অপরাধ।
©Dhananjoy Chandra Das
0 Comments