কে তুমি? পর্ব-০২ [ সাইন্স ফ্রিকশন গল্প ]

কে তুমি?
২য় পর্ব ( স্বপ্নের রানী ) 

ঐ দিনটি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন ছিল। ঐ ছেলেটির ব্যাপারে প্রথমে মাকে বলি, মা তেমন একটা আগ্রহ দেখায় নি। পক্ষান্তরে মা আমাকে কিছু শুকনো কথা শোনাল। তিনি আমাকে বললেন,“ জীবনে চলার পথে এমন বহু লোকের সাথে দেখা হবে যা কখনও মঙ্গল জনক আবার অমঙ্গল জনক ও হতে পারে। তবে তাতে বিচলিত হওয়া যাবে না। মনকে শান্ত করে, স্থির চিত্তে বিবেচনা করে কাজ করতে হবে। যেসব কর্ম নিজের এবং পরিবারের জন্য সুনাম বয়ে আনে এবং সকলের জন্য উপকারী হয়, সেসব কর্মের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। কর্মকেই বড় করে দেখতে হবে, কর্মে ফলকে নয়। যদি তোমার কর্ম সঠিক হয় আর যথার্থ ভাবে তা সম্পন্ন কর, তাহলে ফল অবশ্যই পাবে।” কিছুদিন এর মধ্যেই, বিদেশ থেকে বাবা ফোন দিলে তাকে সব কথা খুলে বলি। তবে তিনিও মায়ের মত কিছু উপদেশ দেওয়া শুরু করলেন। যাইহোক, পরবর্তীতে বাবার কিছু পরামর্শে আমি এক মত হই আর নিজের মনকে শান্ত করি।



ছেলেটির কথাটি নিজের কাছে বেশি দিন চেপে রাখতে পারি নাই। হঠাৎ করে কথাটি বন্ধু মহলে ছেড়ে দেই। ফলে একদল তাকে এলিয়েন বলতে লাগল আবার অন্য একদল বলতে লাগল আমারই দূরের কেউ হবে যে নিজেকে দূরে দূরে রাখতে চায়। আমার বন্ধুমহলটা ছিল বেশ লম্বা যেখানে বৈজ্ঞানিক-অবৈজ্ঞানিক, যৌক্তিক-অযৌক্তিক, ভালো-খারাপ সব ধরনের কথাই চর্চা করা হয়। মাঝে মাঝেই ঝগড়া হয় আবার পরদিন ঠিক হয়ে যায়। আজকে আমার কথাটি নিয়েই বেশ গণ্ডগোল শুরু হয়ে যাচ্ছিলো ঠিক এমন সময় অভির এক কথায় সবাই চুপ হয়ে গেল। অভি চেঁচিয়ে বলেছিল, “এই তুরা থাম দেখি, আজ আমাকে ঐ মেয়েটি অফার দিয়েছে।“ অভির দিকে সবাই হা করে তাকিয়ে রইছে। কারণ অভি এক সুন্দরী মেয়ের পেছনে প্রায় আট মাস ধরে ঘুরে কোনদিন বলতেই পারল না যে কেমন আছ। আজ  ঐ মেয়েই নাকি তাকে অফার দিয়েছে। কথাটি শোনে, প্রথমে আমিও হেসেছি। তবে আমার বন্ধুরা নেগেটিভ-পজেটিভ সব কথাই বলতে পারে। দু'চারটা কথা শোনার পরই বুঝতে পারলাম এখন কোন ধরনের গল্প হবে। তাই ফাউল  কথা কিংবা অন্যবন্ধুর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে মজা নেওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য ওদের ছেড়ে পাঁচ-দশ মিনিট আগেই টিউশনি করাতে চলে গেলাম। তবে যাওয়ার সময় কয়েকজন বন্ধু বাধা দিয়ে বলছিল, “আজ অভিরে পাইছি, তুই চলে যাস না। মাঝে মাঝে কথার ফাকে ফাকে যেভাবে নুন দেস তাতে অনেক জমে উঠে। আজ সুন্দরী মেয়ে নিয়ে তাকে.. ” “থাম, আমি আর এসব নোংরা আড্ডাবাজিতে থাকব না, ঐ দিন দিব্য আমাকে অনেক কিছু বুঝিয়েছে। তুরাও ভালো হয়ে যা।” চলে আসায় আমার ভাল হয়েছিল, খারাপ আড্ডায় থাকতে হয় নি। আমার দেখাদেখি আরও কয়েকজন বন্ধুও চলে গিয়েছিল।

সুমনসহ আরও কয়েকজনকে অঙ্ক পড়াচ্ছিলাম। তারা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। সুমন বেশ মেধাবী ছাত্র, সে আমার খুব প্রিয়। তাকে একটু দেখিয়ে দিলে, নিজ থেকে আরেকটু দেখে নেয়। আমার মতো নিজে নিজে বুঝে পড়ার প্রচন্ড শক্তি আছে। তাকে আমি বইয়ের বাইরে নিজ থেকে বানিয়ে বানিয়ে অঙ্ক দেই, খুব খুশি হয়ে প্রফুল্ল চিত্তে সে অঙ্ক গুলো করে। আজ বন্ধুদের ছেড়ে চলে আসায় আমার মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, সুন্দরী মেয়ে কথাটি  বলায়, ঐ দিন রাস্তায় দেখা হওয়া মেয়েটির কথাও মনে পড়তেছে, যাকে আমার পকেট থেকে গাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়ে চালিয়েছিলাম। তার সমন্ধে কিছু জানার আগেই গাড়ি চলে আসায় সে চলে গেল। দেখতে বেশ রাগি ও ধনী পরিবারের মেয়ে মনে হয়েছে। দুইটা বিশ টাকার এবং তিনটা দশ টাকার নোট তার কাছে নেই কেমন করে! এসব স্মৃতি মনে পড়ার কারনে আমি স্থির হয়ে হাতে কলম নিয়ে বইয়ের অঙ্কের দিকে তাকিয়ে মনের অঙ্ক কষছিলাম, এমন সময় সুমনের ভাইয়া ডাকে স্থিরতা হারিয়ে গতি প্রাপ্ত হই। আমি ভার্সিটি পড়াশোনায় আছি বলে, ওদেরকে বলেছিলাম ভাইয়া ডাকতে। তাই ওরা আমার অনুমতিতেই ভাইয়া ডাকে। আর এই ভাইয়া ডাকে এতই শক্তি যে আমি সব আবেগ মুছে গিয়ে তাদের আগের মত করে অঙ্ক বুঝানো শুরু করি। আজও তাদের নতুন কিছু শিখিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার পূর্বেই বাড়ি ফিরে আসি।

বাড়ি ফিরে আমি আমার কাজ কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ি যার ফলে রাতের খাবারের আগ পর্যন্ত মাথায় কোন ভাবনা আসতে পারেনি। প্রায়ই খাবার খেতে খেতে টিভি দেখি। আজ খুব ক্লান্ত লাছিল তাই টিভি রুমে না গিয়েই ডাইনিং এ বসেই খাওয়া শুরু করে দেই। কারণ খাবার শেষে হলেই, নিজে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার ইচ্ছা। তাই তাড়াতাড়ি অল্পকিছু খেয়েই নিজে রুমে চলে যাই। অল্প করে খেয়েছি কারণ রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লে যাতে পেটের খাবার গলায় না উঠতে পারে এবং সহজেই যেন যেকোন ঝামেলা ছাড়া ঘুমাতে পারি । চোখ বন্ধ, রুম অন্ধকার এবং পাখার শব্দ ছাড়া চারিদিক আর কোন শব্দ নাই। এমন এক পরিবেশে দেহ ঘুমিয়ে গেছে কিন্তু মনের ঘুম আসতেছে না। মন ঘরের সকল দরজা খুলে গেছে আর সেই ঘর হরেক রঙ্গের আলো দিয়ে সজ্জিত হয়ে, নানা সুরে গান ধরেছে। সেই গানে অচেনা-অজানা এক মানুষকে কাছে পাওয়ার প্রয়াস চলিতেছে। 

হঠাৎ গান থামিয়ে একজন এসে বলে উঠল, “তুমি কি আমারই খোঁজ করছিলে?“ পুলকিত হিয়ায়, পলকহীন নেত্রে তার অপরূপ সৌন্দর্য দেখছিলাম। কি সুন্দর তার কেশ! কোমর পর্যন্ত ছেড়ে রাখা কেশগুলো বাতাসে উড়ছে, এলমেলো হয়ে গেলে হা  হা হাসি দিয়ে মাথাটা এপাশ-ওপাশ করে আগের সাজ নেয় আর হাসে। বাতাসের শত বাধা তার সাজে প্রভাব ফেলতে পারছে না। তার মুচকি কিংবা মুদু হাসিতে মুখখানি রঙ্গিন হয়ে আছে। দন্ত দুটি সারিতে যার যার স্থানে বসে থেকে তার হাসির সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি করছে। যত দেখি তত দেখার বাসনা আরও বেড়েই চলছে। এমন সময় লজ্জিত কন্ঠে  নরম সুরে আবার বলে উঠল, “তুমি কি আমারই খোঁজ করছিলে?“ এবারও কোন শব্দ না করে অচেতনভাবে তার রূপ দেখতেছিলাম। তেমন ফর্সা নয় তবে কালোও নয়। শ্যামবর্ণের যেন তার সম্পূর্ন শরীর কাচা হলুদে মাখা। যেন সূর্যের কিরণ ছড়াচ্ছে আর সেই ঘরকে আরও রঙ্গিন করে দিচ্ছে। সে আবারও করুন সুরে বলল,  “তুমি কি আমারই খোঁজ করছিলে?“ এবার চুপ না থেকে মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ।” “শুধু আজ নয়, তোমার সাথে মনে খুলে কিছু বলব ভেবে প্রত্যেকটা দিবসে তোমাকে খোঁজ করি। তুমি কি ঐ দিনের সেই মেয়েটি?”
- না…
- কে তুমি?
- রাজলক্ষ্মী রির্সট এ আস প্লিজ। এই চাবিটা হাতে নাও, আর রবিবারে চলে আসবে, রির্সটে অপেক্ষায় থাকব। এখন যেতে হবে, বাড়ি ফিরে যথাসময়ে একটা গাড়ি তোমার ঠিকানয় পাঠিয়ে দিব।
- আচ্ছা! কে তুমি? তোমার নামটা বলে যাও, যেএ-এ-ওনা, যেওনা…..
- (গাড়িতে উঠতে উঠতে ) পরবর্তী রবিবারে দেখা হলেই।
সে চলে গেল তবে মনের ভেতরে আগুন জ্বেলে। আছে যত অলসতা, স্থিরতা, অবজ্ঞা, অচেতনতা, ক্লান্তি, দুঃখ সব তার আগুনে পুড়ে গিয়ে ফিরে পেলাম সেই সব যা আমাকে আমার করে চিনতে শেখায়। আজ সপ্তাহের শেষ দিন, বৃহস্পতিবার। এই দুই দিন নিজেকে নিয়ে নিজে অনেক গবেষণা করেছি। নিজেকে ভালো করে জানতে পেরেছি তার সাথে আরেক জন অচেনা মানুষকে জানার আগ্রহ খুজে পেয়েছি। সেই অচেনা মানুষের প্রতি জেগেছে অন্যরকম এক অনুভূতি, যা আমার চলার গতিই পাল্টে দিচ্ছে। তার জন্য মাত্র দুইদিন অপেক্ষা করা, তা কয়েক বছর অপেক্ষা করার মত মনে হচ্ছে। কখন তার সাথে দেখা হবে আর কখন রবিবার আসবে তার প্রহর-ক্ষণ-মুহূর্ত গুনতে লাগলাম। 

শুক্র-শনি শেষে রবিবারে ভোর হতেই দেখি আমার বাড়ির গেটের সামনে একটা গাড়ি। গেটের সামনে এটি আমার নাম ধরে ডাকতেছে এবং আমাকে কোথায় যেতে হবে তা ও মনে করিয়ে দিচ্ছে। গাড়িটি বেশ অত্যাধুনিক, স্বয়ংক্রিয় ভাবে চলতে পারে। জিপিএস ব্যবহার করে, ড্রাইভার ছাড়াই গেটের সামনে চলে এসেছে। এটি তথ্য উপস্থাপন এবং বিনিময় সহ নানা জটিল কাজ করতে পারে। গাড়িটি কেন্দ্রীয় ভাবে কোন একজন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা, তাতে কোন সন্দেহ নাই। গাড়িটি গেটের সামনে যতক্ষণ আমার জন্য অপেক্ষা করছিল ততক্ষণ নানা ধরনের কথা বলে যাচ্ছিল তবে সেটা আমার প্রয়োজনের বাইরে না। যাইহোক, আমার হাতে যে চাবিটা দিয়েছিল সেটা ছিল ডিজিটাল, তাতে একটা গোপন চিহ্ন ছিল যা গাড়ির নির্দিষ্ট স্থানে বিশেষ যন্ত্রে প্রবেশ করানো মাত্রই ভেতরে যাওয়ার অংশটুকু খুলে গেল। আমি গাড়ির ভেতরে গিয়ে বসা মাত্রই গাড়িটি আমাকে কিছু প্রশ্ন করা শুর করল।
- স্যার, আপনি কি স্ব-ইচ্ছায় উঠেছেন? 
- হ্যাঁ, নিজের ইচ্ছায়।
- আপনার সাথে আর কেউ যাওয়ার অনুমতি না থাকলে প্রবেশ পথ বন্ধ করে দিব কি?
- হ্যাঁ, বন্ধ করে দাও। 
- স্যার, আপনার কি গরম লাগছ তাহলে এসি অন করে দিব?
- না।
- আপনাকে নিয়ে কোথায় যেতে হবে?
- রাজলক্ষ্মী রিসর্টে।
- ওকে, সিট ব্যাল্ট টা লাগিয়ে নিন।
গাড়িটি আমার থেকে লোকেশন জানার পর স্বয়ংক্রিয় ভাবে তার যাত্রা শুরু করল। পথে তার গতি উঠানামা করে স্বয়ংক্রিয় ভাবে। যখন তার সামনে কোন বাধা আসে তখন সে তার গতি কমিয়ে নেয় এবং প্রয়োজনে শূন্যে এসে অপেক্ষাও করতে পারে। রাস্তা খালি পেলে আরামদায়ক গতিতে গাড়ি চালনা করে। খানিকটা পথ অতিক্রম করার পর গাড়িটি আমাকে আবারও প্রশ্ন করা শুর করল তবে এবার আমার অনুমিত সাপেক্ষ। অর্থাৎ গাড়িটি বলল,
- স্যার, আপনি যদি বিরক্তি না হোন তাহলে আপনাকে আরও কিছু প্রশ্ন করতে পারি?
- হ্যাঁ, করতে পার। 
না বললে গাড়িটি তার প্রশ্ন করা থামিয়ে দিয়ে চুপচাপ চলতে থাকত।
- আপনাকে আমি কীভাবে সহযোগীতা করতে পারি? গান গেয়ে, ভিডিও দেখিয়ে, খবর পড়ে.. ( এমন আরও কয়েকটি অপশন বলতে লাগল )
- গান গেয়ে।
গাড়িটি আমার থেকে জানতে চাইল কোন ধরনের গান কিংবা কোন গায়কের গান শোনতে চাই। সে আমার পছন্দ অনুযায়ী গান বাজনো শুরু করে দিল। বেশ ভালোই লাগতেছিল কিন্তু সূর্য যত প্রকাশিত হতে লাগল তার উত্তাপ ও বেশ লাগতেছিল। ফলে আমি গাড়িটিকে বললাম,
- হ্যালো, কার (গাড়ি )। তুমি কি আমাকে একটা সাহায্য করবে?
- ( তৎক্ষণাৎ )। হ্যাঁ,  স্যার। কীভাবে?
- গাড়ির এসি অন করে দাও।
- ওকে, এসি অন করে দিয়েছি।
গাড়িটি চলার পথে আমাকে নানা ভাবে সহযোগীতা করেছে। একাকীত্ব দূর করার জন্য আমার সাথে গল্পও করেছে। গাড়িটির বুদ্ধিমত্তা বেশ উন্নত। যে কোন প্রশ্নের উত্তর এটি সাথে সাথে দিতে পারে। কোন ঝামেলা এবং সমস্যা না করে বরং নানা সমস্যা সমাধানে সহযোগীতা করে যথাযথ সময়ে রাজলক্ষ্মী রির্সটে এসে পৌছাল।

রিসর্টে পৌছানো মাত্রই গাড়ি থেকে বের হবার জন্য একটা দরজা স্বয়ংক্রিয় ভাবে খুলে গেল। সেখানে গেটের সামনে, কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করা মাত্রই সে চলে আসল। তার হাতে ছিল নানা রঙ্গের তাজা তাজা ফুল। সে এগুলো আমার হাতে তুলে দিয়ে জড়িয়ে ধরে স্বাগতম জানাল। সে বলল, “এখানে আসবে, আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেছি আর তুমি তা সত্যিও করেছ। তাতে আমি অনেক খুশি।” এই বলে আমার হাত ধরে, ধীরে ধীরে একটা হোটেলের ভেতরে গিয়ে বসল। ওহ্হু! শুধু সে আমাকে একাই স্বাগতম জানায়নি বরং স্বয়ংক্রিয় ভাবে চলতে পারে এমন কতগুলো যন্ত্রও  ( রোবট )  জানিয়েছে। আমরা দু'জন একটা টেবিলের দু'পাশে মুখোমুখি বসে কথা বলছিলাম এমন সময় একটা যন্ত্র এসে আমাদের দু'জনকে হালকা একটা পাম দিয়ে কিছু প্রশ্ন শুরু করে দিল। মানে যন্ত্র বলতে লাগল,
- ম্যাম ও স্যার কে বেশ মানিয়েছে। আপনাদেরকে আমি চা, কফি কিংবা অন্য কোন ভাবে সাহায্য করতে পারি কি?
- (আমি চুপ রইলাম) হ্যাঁ, দু'টি কোল্ড কফি।
- আর কোন ভাবে সাহায্য করতে পারি?
- এখন না, পরবর্তীতে প্রয়োজনে ডাকা হবে।
আমরা দু’জনে দু’টি কফি মুখে নিচ্ছি আর একে অপরের দিকে  তাকাচ্ছি। আমাদের সাহায্য করার জন্য আমাদের পাশে একটি যন্ত্র দাড়িয়ে রইল। এটি আমাদের নানা ভাবে সহযোগীতা করে চলছে। কখন অর্ডার গ্রহণন করে কিংবা টেবিল পরিষ্কার করে। তবে আমার মনে হচ্ছে, এটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার একটি বিশেষ স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র যা নিজ থেকে বুঝতে পারে কোনটি প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয়। যে কোন অর্ডার কিংবা কাজের নির্দেশনা আমার সামনে যে মেয়েটি বসা সে মেয়েটির তার হাতে থাকা স্মার্ট ডিভাইসটি দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করছে। আমি তা দেখে অবাক নয় কারণ কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্র আমি। তবে এটা ভেবে খুবই বিস্মিত যে একটা মেয়ে আমাকে ডেটিং এ ডেকেছে এমন এক পরিবেশ যা সম্পূর্ন ভাবে একটা আর্টিফিশিয়াল (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার) জগৎ। চারদিকে মানুষ বলতে কিছুই নেই আছে শুধু বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র যা যার যার কাজে ব্যস্ত। জনহীন এমন পরিবেশে খারাপ লাগার কথা কিন্তু ভালই লাগছে। তবে জানার যে ইচ্ছা তা বেড়ে যাচ্ছে। তাই অতি আবেগহী না হয়ে ধীরে নীচু গলায়  আমার সামনে যে মেয়েটি বসা সে মেয়েটিকে জিঙ্গেস করলাম,
- এখানে কি কোন মানুষ জন আসে না?
- (একটু হেসে) আমরা কি মানুষ না! তবে আজকে আসার জন্য নিষেধ করা হয়েছে।
- কেন?
- আজ এই জায়গায় তুমি-আমি সময় কাটাব। যদি অন্য কেউ থাকে আর ঝামেলা তৈরি করে তাহলে আমাদের ডেটিং ব্যর্থ হয়ে যাবে। আর এমনতেই এখানে বেশি মানুষ আসার সুযোগ পায় না হাতে গুণা কয়েকজন আসতে পারে। ফলে এটা জনহীন রিসর্ট মনে হয়।
- তুমি কি আজকের দিনের জন্য পুরো রিসর্ট ভাড়া নিয়েছো?
- হুম, আজকের দিনটিতে এখানে শুধু আমরাই থাকব।
- তুমি এত কিছু করতে গেলে কেন?
- চল, ঐ দিকটা হাঁটতে হাঁটতে দেখি।
এই বলে আমাকে নিয়ে হোটল থেকে বের হয়ে গেল। আমাদের সাথে একটা যন্ত্রও বের হচ্ছিল তখন সে যন্ত্রটিকে বলল, “তুমি এখন আমাদের সাথে আসার দরকার নাই যখন প্রয়োজন হবে তোমাকে ডাকা হবে। “যন্ত্রটি থেমে হোটলের দিকে চলে গেল। আর আমরা রিসর্টের বিভিন্ন অংশ দেখার জন্য বের হলাম।

এটা কোন রিসর্ট নয় যেন একটা স্বর্গরাজ্য। দেখি নাই স্বর্গ কীভাবে সজ্জিত তবে দেখেছি রাজলক্ষ্মী রিসোর্টের অপরূপ সৌন্দর্য। রিসোর্টের প্রধান হোটেল থেকে বের হয়ে চারিদিক  রঙবেরঙ এর ফুল আর ছোট ছোট ঘাসের উপর দিয়ে একটু হেটে গেলেই একটা সুইমিংপুল পুল যা নানা আকৃতিতে বিশাল জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। সুইমিং পুলের চারপাশে বসার জন্য রয়েছে হরেক রকমের  আসন। সুইমিংপুলকে এই রিসর্টের  কেন্দ্র বলা যায়। চারদিকে নানা প্রজাতির ঝোপে ও বৃক্ষে পরিপূর্ণ। কিছু সংখ্যক প্রাকৃতিক হলেও বাকি সব কৃত্রিম। এখানে প্রযুক্তির ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে চিড়িয়াখানা এবং জাদুঘর। এই প্রযুক্তি গুলো এতই বাস্তবিক, বোধগম্য হচ্ছিল না যে যা দেখতেছি বা অনুভব করতেছি সব প্রযুক্তির খেলা। যা-ই দেখিনা কেন একজনের থেকে কোন রকমেই চোখ নড়ছিল না তবে সে এমন ভাবে হাটছিল যা আমার থেকে কিছুটা দ্রুত। ফলে সে আমার থেকে কিছুটা সামনে চলে যায় কারন আশেপাশের প্রযুক্তির নানা জাদু আমাকে আকর্ষিত করে চলার গতি ধীর করে দিয়েছিল। তাই আমি তাকে কাছে পাওয়ার জন্য উচ্চস্বরে একটা শব্দ করে বললাম, 
- এই যে! আমাকে ফেলেই তুমি সামনে চলে যাচ্ছো কেন? 
কয়েক সেকেন্ডেই আমি তার নিকট পৌঁছে যাই। যাওয়া মাত্রই সে আমার হাতটা টেনে মুট করে ধরে এবং একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
- তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?
- হ্যাঁ, ভালবাসি। এজন্যই তোমার সাথে এখানে দেখা করতে এসেছি।
- ভালবাসলে, নাম ধরে ডাক দিলে না কেন?
- ইয়ে..মানে…! আসলে একটা সত্যি কথা বলব?
- বল?
- তোমাকে এতটা ভালবেসে ফেলেছি যে নাম জিজ্ঞাসার  প্রয়োজন হয় নি তাই জানা হয় নি।
- ( বিস্মিত একটা মৃদু  হাসি দিয়ে) তার মানে! 
- মনে মনে তোমার একটা নাম দিয়েছি।
- তাই নাকি? তাহলে মনের দেওয়া নাম ধরেই ডাক দিতে।
- যদি পছন্দ না হয়! আর তুমিই যদি ভেবে বস অন্য কাউকে ডাক দিয়েছি!
- তোমাকে আমি ও অনেক ভালবাসি। ভালবাসার একটা শক্তি আছে যা অনুভব করা যায়। ভালবেসে ডাক দিলে তা বোঝার সামর্থ্য আছে। আর তোমাকে আমি যথেষ্ট চিনি। কি ছিল?
- বলব! পছন্দ না..
- (হাসতে হাসতে পিটে একটু খোঁচা দিয়ে) ঢং! বল দেখি?
- উ্উ-অ্অপ..
- (বাহু বাহুতে আলতু ধাক্কা দিয়) দেখ কি লজ্জা…
- উপমা, উপমা..
- (হা হা হাসিতে) বাহ্! খুব ভাল লেগেছে।
- সত্যি!  তবে তোমার আসল নাম, ঠিকানা কিছুই জানা হল না…
- দরকার নাই, আমি তোমাকে ভালবাসি এটাই বড় পরিচয়। আজ থেকে আমি তোমারই উপমা।
আরও নানা কথা বলতে বলতে রিসর্টের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বট বৃক্ষের নীচে দুর্বাঘাসের উপর বসে পড়লাম। বট বৃক্ষের নীচে বসে আমাদের রোমান্টিক আলাপ শেষই হচ্ছে না, দীর্ঘ আরো দীর্ঘ হচ্ছে। এমন সময় উপমার হাতে থাকা ডিভাইস বলে উঠল,
- দুপুর ঘনিয়ে এসেছে। বাইরে সূর্যের উত্তাপ প্রখর হচ্ছে, সূর্যের এই রশ্মি ত্বকের জন্য বেশ ক্ষতিকর। এখনই হোটেলে ফিরে গেলে ভালো হবে। তবে এই জায়গাটি বেশ ভালো, প্রচুর অক্সিজেন রয়েছে যা দেহের জন্য বেশ উপকারী। যদি ক্লান্তি অনুভব হয় তাহলে পানীয় কিছু গ্রহণ করা উত্তম হবে।
উপমা তার পকেট থেকে ডিভাইসটি হাতে নিয়ে দু’টা ঠান্ড পানীয় এবং একটা মিনি গাড়ি আসার জন্য অর্ডার করেছে। এই রিসর্টে অনেক গুলো স্বয়ংক্রিয় মিনি গাড়ি আছে যা ভ্রমণকে আরও আনন্দদায়ক করে তুলে। আর কিছু সময়ের ভেতর এগুলো এসে হাজির। আমাদের কথাবার্তা শেষ করতে করতে না করেই গাড়ি দিয়ে হোটেল ফিরে আসলাম। 

হোটেলের অভ্যন্তরীণ সুইমিংপুলে আমরা দু’জনে একত্রে স্নান করে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম করার জন্য হোটেলের বিনোদন কক্ষগুলোর দিকে গেলাম। জীবনে যত ধরনের বৈধ বিনোদন নেওয়া যায় তার সবই আছে। কোন কিছু দেখার জন্য বিশাল বড় মনিটর সহ নানা প্রদর্শনী, শোনার জন্য সাউন্ড সিস্টেম, পড়ার জন্য বিশাল ডিজিটাল বুকের সমাহার, খেলার জন্য সব ধরনের বহু মাত্রিক খেলা অর্থাৎ দাবা, লডু ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, কাবাডি, টাংডেম, মার্বেল সহ আরও হরেক রকমের খেলা। খেলা গুলো খেলতে হলে বিশেষ ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার করা হয়। আমি উপমার সাথে বিভিন্ন খেলায় স্ব-ইচ্ছায় হেরেছি কখনও সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও হারাতে পারি নাই। জেতবার সংখ্যা উপমার চেয়ে আমারই বেশি হবে। কখনও কখনও আমার ঠকা খেলা জেতে গেছি। হতে পারে উপমা নিজের ইচ্ছা করে আমাকে জিতিয়ে দিয়েছে খুশি থাকার জন্য। সন্ধ্যা হতে হতে সব ধরনের বিনোদনের স্বাদ গ্রহণ সম্পূর্ন। 

সন্ধ্যা গত হলে রাত্রি ফিরে আসে, রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাই একই কক্ষে। কক্ষে প্রবেশ করা মাত্রই একটা যন্ত্র হতে একছটা আলো এসে পড়ে আমাদের উপরে। তেমন পাত্তা না দিয়েই দু'জনে খাটে গিয়ে বসে পড়ি। দু'জনে সারাদিনে যেসকল ছবি তুলেছিলাম সেগুলো দেখছিলাম। হঠাৎ উপমা আমার গালে চুমু দেওয়ার ভঙ্গীতে একটা ছবি তুলল তা দেখে আমি ও তার কপালে চুমু খাচ্ছি এমন ভঙ্গীতে একটা ছবি তুলে নিলাম। এমন সময় রুমে থাকা যন্ত্রটি রেড এলার্ম দিতে দিতে বলতে লাগল,
- আপনার দু'জনেই অবিবাহিত। দু'জন দু'জনের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু তার বেশি নয়। আপনারা দু'জন দু'জনের যতটুকু কাছাকাছি গেছেন তা ঠিক আছে তবে তার চেয়ে বেশি কাছাকাছি যেতে চেষ্টা করবেন না। অর্থাৎ এমন কিছুই করা যাবে না যা আপত্তিকর এবং আইনগত দণ্ডনীয়। যদি করার চেষ্টা করেন কিংবা করেন তাহলে আমি এসব তথ্য যথাযথ স্থানে পৌঁছে দিব ফলে আপনাদের জবাবদিহিতা করতে হবে। আমার স্বয়ংক্রিয় কাজ করার ক্ষমতা নষ্ট করতে আসলে আহত হতে হবে। সাবধান! সাবধান!
যন্ত্রটি এমন ভাবে সাবধান করল যার ফলে অবচেতন মনের সকল চেতনা দেহে ফিরে আসল। চোখ মেলে চারিদিকে তাকিয়ে দেখি পরিবেশ সব পাল্টে গেছে আর আমি সেই আমার ঘরের বিছানায় সুইয়া আছি এবং পাশে থাকা সুন্দরী মেয়েটি ও  নাই। বিশ্বাসই হচ্ছে না যে এই মাত্র ঘুম ভেঙ্গেছে। তাই বারে বারে হাত দিয়ে চোখ মুছে এদিকওদিক তাকাই আর খুজি কোথায় আছে আমার সেই স্বপ্নের রানী। কক্ষটি প্রভাতের সূর্যের আলোতে হালকা আলোকিত হতে হতে আরও আলোকিত হতে লাগল। ততক্ষণে আমার সব ভ্রম চলে গেল। স্বপ্নের রানী বাস্তবে পাওয়ার দৃঢ় প্রত্যাশা নিয়ে বিছানা ছেড়ে প্রতিদিনের কাজে লেগে পড়লাম। 

[ ৩য় পর্ব, খুবই দ্রুত আসতে পারে। ৩য় পর্ব হবে “আর্শীবাদেও অভিশাপ লাগে”। প্রযুক্তি আর্শীবাদ হওয়া সত্তেও কেন, কীভাবে, কেমন করে তাতে অভিশাপ লেগে গেল? ]

১ম পর্ব পড়তে: ক্লিক করুন

লিখটাটি কপি করে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া, আইনগত দণ্ডনীয় অপরাধ।
©Dhananjoy Chandra Das

Post a Comment

0 Comments